প্রকৃতি-প্রত্যয় Last updated: 6 months ago
প্রকৃতি
শব্দমূল বা শব্দের যে অংশকে আর ভাঙা যায় না, তাকে প্রকৃতি বলে। প্রত্যয় যুক্ত প্রতিটি মৌলিক শব্দ তথা প্রত্যয় যুক্ত প্রতিটি প্রাতিপদিক ও ধাতুই একেকটি প্রকৃতি। কিন্তু মৌলিক শব্দকে প্রকৃতি বলা যায় না। যখনই সেই শব্দের সঙ্গে বা অতিরিক্ত শব্দাংশ বা প্রত্যয় যুক্ত হয়ে নতুন শব্দ গঠন করে, তখনই কেবল নতুন সৃষ্ট শব্দটির মূল শব্দটিকে প্রকৃতি বলা যায়।
অর্থাৎ, প্রত্যয় সাধিত শব্দের মূলশব্দকে বলা হয় প্রকৃতি। কিন্তু শব্দটি থেকে প্রত্যয় সরিয়ে ফেললে, মূলশব্দটিকে তখন আর প্রকৃতি বলা যাবে না।
যেমন- লাজুক, বড়াই, ঘরামি, পড়ুয়া, নাচুনে, জিতা শব্দগুলোর মূলশব্দ যথাক্রমে লাজ, বড়, ঘর, পড়, নাচ, জিত। এখানে, লাজুক, বড়াই, ঘরামি, পড়ুয়া, নাচুনে, জিতা শব্দগুলো প্রত্যয়সাধিত (মূলশব্দের সঙ্গে অতিরিক্ত শব্দাংশ বা প্রত্যয় যুক্ত হয়েছে।) আর এই শব্দগুলোর মূলশব্দ লাজ, বড়, ঘর, পড়, নাচ, জিত। অর্থাৎ লাজ, বড়, ঘর, পড়, নাচ, জিত- এগুলো লাজুক, বড়াই, ঘরামি, পড়ুয়া, নাচুনে, জিতা শব্দগুলোর প্রকৃতি। কিন্তু আলাদাভাবে উল্লেখ করলে এগুলো আর প্রকৃতি নয়, এগুলো তখন স্রেফ কতোগুলো মৌলিক শব্দ।
প্রত্যয় শব্দের ব্যুৎপত্তি ও অর্থ
প্রত্যয় শব্দটির ব্যুৎপত্তি হল - প্রতি - √ই + অ (অচ্) এবং আভিধানিক অর্থ হল - বিশ্বাস। প্রত্যয় ব্যুৎপত্তিকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে √ই ধাতুর অর্থ যাওয়া এবং প্রতি উপসর্গের অর্থ দিকে। অর্থাৎ প্রত্যয় শব্দটির অর্থ - দিকে গমন > শব্দ গঠনের দিকে গমন > শব্দ গঠনের পদ্ধতি।
প্রকৃতি ২ প্রকার-
নাম প্রকৃতি: প্রাতিপদিকের সঙ্গে প্রত্যয় যুক্ত হলে প্রাতিপদিকটিকে নাম প্রকৃতি বলে। যেমন, উপরের লাজ, বড়, ঘর- এগুলো নাম প্রকৃতি।
ক্রিয়া প্রকৃতি: ধাতুর সঙ্গে প্রত্যয় যুক্ত হলে ধাতুটিকে ক্রিয়া প্রকৃতি বলে। যেমন, উপরের √পড়, √নাচ, √জিত- এগুলো ক্রিয়া প্রকৃতি।
প্রত্যয়
মূলশব্দ বা মৌলিক শব্দের সঙ্গে যে অতিরিক্ত শব্দাংশ যুক্ত হয়ে নতুন নামপদ গঠন করে, তাকে প্রত্যয় বলে। অর্থাৎ, প্রাতিপদিক ও ধাতুর সঙ্গে যেই শব্দাংশ যুক্ত হয়ে নতুন শব্দ গঠন করে, তাদেরকেই প্রত্যয় বলে। উপরের উদাহরণে, লাজুক শব্দের প্রকৃতি ‘লাজ’-এর সঙ্গে প্রত্যয় ‘উক’ যুক্ত হয়ে গঠিত হয়েছে ‘লাজুক’ শব্দটি। এমনিভাবে
প্রকৃতি + প্রত্যয় = প্রত্যয়সাধিত শব্দ
বড় + আই = বড়াই
ঘর + আমি = ঘরামি
পড় + উয়া = পড়ুয়া
নাচ + উনে = নাচুনে
জিত + আ = জিতা
প্রত্যয় ২ প্রকার-
কৃৎ প্রত্যয়
ক্রিয়া প্রকৃতির সঙ্গে যেই প্রত্যয় যুক্ত হয়, তাকে কৃৎ প্রত্যয় বলে। যেমন, উপরের উদাহরণে, ‘√পড়’-এর সঙ্গে যুক্ত হওয়া ‘উয়া’, ‘√নাচ’-এর সঙ্গে যুক্ত হওয়া ‘উনে’ এবং ‘√জিত’-এর সঙ্গে যুক্ত হওয়া ‘আ’ কৃৎ প্রত্যয়।
তদ্ধিত প্রত্যয়
নাম প্রকৃতির সঙ্গে যেই প্রত্যয় যুক্ত হয়, তাকে তদ্ধিত প্রত্যয় বলে। যেমন, উপরের উদাহরণে, ‘লাজ’-এর সঙ্গে যুক্ত হওয়া ‘উক’,‘বড়’-এর সঙ্গে যুক্ত হওয়া ‘আই’, ‘ঘর’-এর সঙ্গে যুক্ত হওয়া ‘আমি’ তদ্ধিত প্রত্যয়।
কৃদন্ত পদ
কৃৎ প্রত্যয় সাধিত পদটিকে বলা হয় কৃদন্ত পদ। অর্থাৎ যে নাম পদ (বিশেষ্য বা বিশেষণ পদ) ক্রিয়ামূল বা ধাতুর সঙ্গে কৃৎ প্রত্যয় যোগ হয়ে গঠিত, তাকে কৃদন্ত পদ বলে। সহজ ভাষায় বলতে গেলে, ক্রিয়ামূল বা ধাতু থেকে গঠিত বিশেষ্য
বা বিশেষণ পদকেই কৃদন্ত পদ বলে। যেমন, উপরের পড়ুয়া, নাচুনে, জিতা।
তদ্ধিতান্ত পদ
তদ্ধিত প্রত্যয় সাধিত শব্দকে তদ্ধিতান্ত পদ বলে। যেমন, উপরের লাজুক, বড়াই, ঘরামি। অনেক সময় কৃৎ প্রত্যয় যুক্ত হওয়ার ক্রিয়া প্রকৃতি বা ধাতুর আদিস্বর অনেক সময় পরিবর্তিত হয়। এই পরিবর্তন যথেচ্ছভাবে হয় না, কিছু নিয়ম
অনুসরণ করে হয়। কৃৎ প্রত্যয় ব্যবহৃত হওয়ার সময় পরিবর্তন হওয়ার নিয়ম ২টি- গুণ ও বৃদ্ধি।
গুণ:
ই/ঈ-স্থলে এ |
√চিন+আ= চেনা, √নী+আ= নেওয়া |
উ/ঊ-স্থলে ও |
√ধু+আ= ধোয়া |
ঋ-স্থলে অর |
√কৃ+তা = করতা ˃ ক্রেতা |
বৃদ্ধি:
অ-স্থলে আ |
√পচ+ণক(অক) = পাচক |
ই/ঈ-স্থলে ঐ |
√শিশু+ষ্ণ = শৈশব |
উ/ঊ-স্থলে ঔ |
√যুব+অন= যৌবন |
ঋ-স্থলে আর |
√কৃ+ঘ্যণ(য-ফলা)= কার্য |
- কেবল ভাববাচ্যে ‘অ’ প্রত্যয় যুক্ত হয়। যেমন: ধর, মার।
- আধুনিক বাংলায় ‘অ' প্রত্যয় সর্বত্র উচ্চারিত হয় না। যেমন: হার, জিত্।
- ক্রিয়াবাচক বিশেষ্য গঠনে ‘অন’ প্রত্যয় ব্যবহার হয়। যেমন: কাঁদন, দোলন, নাচন ইত্যাদি।
- কৃৎ প্রত্যয় ২ প্রকার। যথা: বাংলা ও সংস্কৃত।
- তদ্ধিত প্রত্যয় ৩ প্রকার। যথা: বাংলা, সংস্কৃত ও বিদেশি।
কৃৎ প্রত্যয়ের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ ক্রিয়ামূল /ক্রিয়াপ্রকৃতি
০১. উপ্ত,উপ্তি,বপন,বপনীয় – √বপ্।
০২. কার্য, করণ, করণীয়, কারক, কর্তা, কর্তৃ, কর্তব্য, কর্ম, কৃতি, কৃত্রিম, ক্রিয়া – √কৃ।
০৩. ক্রয়, ক্রেতা, ক্রীত, ক্রীতব্য – √ক্রী।
০৪. ক্ষয়, ক্ষেত্র, ক্ষয়িষ্ণু- √ক্ষি।
০৫. গত, গতি, গমন, গন্তব্য, গম্য – √গম।
০৬. গ্রহ, গ্রাহী, গ্রহণ, গ্রহীতা, গ্রাহক, গ্রহণীয়, গ্রাহ্য – √গ্রহ।
০৭. গান, গীতি, গায়ক – √গৈ।
০৮. চলন, চলনীয়, চলন্ত, চলিষ্ণু, চলমান, চলা, চলিত,চলিতব্য – √চল। চালক – √চালি।
০৯. চর, চরণ, চরম, চরিত, চরিফু, চর্য, চর্ম – √চ।
১০. চারণ, চারণা, চারক – √চারি।
১১. ছিন্ন, ছেদন, ছেদনীয়, ছেদনী – √ছিদ্।
১২. জননী, জনক – √জনি।
১৩. জয়, জেয়, জয়ী, জয়িতা, জেতা, জেতব্য, জিষ্ণু, জয়িষ্ণু –√জি।
১৪. দম, দম্য, দমী, দমন, দমনীয় – √দম্।
১৫. দর্শন, দর্শনীয়, দর্শক, দৃশ্য, দৃশ্যমান, দৃষ্টি, দৃষ্ট, দ্রষ্টা– √দৃশ্।
১৬. দায়, দায়ী, দেয়, দান, দাতা, দাতব্য, দত্ত – √দা।
১৭. ধরা, ধর, ধরুন, ধরণি, ধরণীয়, ধর্তব্য, ধায়ী, ধার্য, ধরিত্রী,ধর্ম – √ধূ। ধারক – √ধারি।
১৮. নয়ন, নেতা, নায়ক, নেত্র – √নী।
১৯. নষ্ট, নাশ – √নশ। নাশক – √নাশি।
২০. নিন্দক, নিন্দন, নিন্দা, নিন্দনীয় – √নিন্দ্।
২১. পঠন, পাঠ্য, পঠিত, পঠিতব্য, পঠনীয়, পাঠক – √পঠ্।
২২. পান, পেয়, পানীয়, পাতা, পাত্র-√পা। পাতক – √পাতি।
২৩. পালক, পালন, পালনীয়, পালিত, পালয়িতা – √পাল্।
২৪. পচ্য, পচন, পাচক, পাচিত, পাক – √পচ্।
২৫. পূজা, পূজক, পূজনীয়, পৃজিত, পূজারি - √পূজ্।
২৬. বচন, বাচ্য, বচনীয়, বাচক, বাক্য, বক্তা, বক্তব্য, উক্ত, উক্তি- √বচ্
২৭. বহন, বহনীয়, বহমান, বাহ, বাহক – √বহ্,বাহন- √বাহি।
২৮. বৃদ্ধি, বৃদ্ধ, বর্ধমান, বর্ধিষ্ণু – √বৃধ্।
২৯. বুদ্ধ, বুদ্ধি –√বুধ্।
৩০. বর্ধক, বর্ধন, বর্ধিত – √বর্ধি
৩১. ভয়, ভীত, ভীতি, ভীরু, ভীম- √ভী।
৩২. ভাগ, ভাজ্য, ভাজন, ভাজক – √ভজ্।
৩৩. ভক্ত, ভক্তি, ভজন, ভজ্য, ভজনীয় – √ভজ্।
৩৪. ভুক্ত, ভুক্তি, ভোক্তা, ভোজন, ভোজ্য, ভোজক, ভোগ্য – √ভুজ্।
৩৫. মতি, মত, মন, মন্তা, মনন, মনু, মন্তব্য- √মন্।
৩৬. মান, মাত্র, মাত্রা, মাতা, মিত, মিতি, মায়া, মেয়-√মা
৩৭. মাপ্য, মাপন, মাপক – √মাপি।
৩৮. মুক্তা, মুক্ত, মুক্তি, মুক্তক, মোচন, মোচক, মোচনীয় –√মুচ্
৩৯. বুদ্ধ, বুদ্ধি – √বুধ্।
৪০. যুদ্ধ, যোদ্ধা, যোধন, যোধ – √যুধ।
৪১. যুক্ত, যুক্তি, যোগ, যোগী, যোজন, যোজক – √যুজ্।
৪২. লাভ, লভ্য, লব্ধ – √লভ্।
৪৩. শান্ত, শান্তি – √শম্।
৪৪, শ্রান্ত, শ্রান্তি, শ্রম, শ্রমী, শ্রমিক – √শ্রম।
৪৫. শ্রবণ, শ্রবণীয়, শ্রাব্য, শ্রুতি, শ্রুত, শ্রোতা, শ্রোত্র – √শ্রু।
৪৬. শিক্ষা, শিক্ষক, শিক্ষিত, শিক্ষণীয় – √শিক্ষ্।
৪৭. সহ্য, সহন, সহনীয়, সহিষ্ণু, সহিতব্য – √সহ্।
৪৮. স্মরণ, স্মরণীয়, স্মারক, স্মৃতি, স্মর্তব্য- √স্ম্য।
৪৯. স্থায়ী, স্থান, স্থাবর, স্থিত, স্থিতি, স্থির, স্থাপন, ছাতব্য-√স্থা।
৫০. স্রষ্টা, সৃষ্ট, সৃষ্টি, সৃজন – √সৃজ্।
৫১. সিক্ত, সেচ, সেচন, সেচক – √সিচ্।
৫২. সহন, সহনীয়, সহ্য- √সহ্।
৫৩. সুপ্ত, সুপ্তি – √স্বপ্।
৫৪. হত, হত্যা, হনন, হন্তা, হন্তব্য, ঘাত, ঘাতী, ঘাতক, ঘাতন – √ঘাতি।
৫৫. হিংসা, হিংস্র, হিংসন, হিংসনীয়, হিংসা, হিংসন –হিন্স্।
গুরুত্বপূর্ন কিছু কৃৎ প্রত্যয়ের উদাহরণ
এই পোস্ট সহায়ক ছিল?
0 out of 0 Marked as Helpfull !